গল্প- হানিমুন

হানিমুন
-রাখী চক্রবর্তী

 

 

ঘন কুয়াশায় মিঠুর বাড়ির বাগান ঢেকে গেছে। টুনি গেঁদার গাছটা ফুল ভর্তি হয়ে আছে। দেবেশ মিঠুকে কোলে তুলে নিয়ে বাগানের সামনে দিয়েই আসছে। গেটের বাইরে অটো দাঁড়িয়ে। কুমার আগেভাগে অটোতে বসে পড়েছে।
– ‘মিঠু.. মিঠু তোমাকে এইভাবে সারাজীবন ধরে রাখব।’
মিঠু চোখ পাকিয়ে দেবেশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তাই বুঝি! কোল থেকে নামাও কুমার চলে আসবে। এবারও মনে হচ্ছে ট্রেন আমাদের না নিয়েই পুরী ছুটবে। ছাড়ো, গত বছর তো এই করে পুরী যাওয়াই হলো না আমাদের।’
গত বছর দেবেশ যে পুরীর টিকিট কাটেনি তা আজও জানে না মিঠু। ট্রেনের টাইম ভুল বলে বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিল দেবেশ মিঠু ও ওদের একমাত্র সন্তান কুমার ।
টিকিট না কেটে পুরী যাওয়ার নাটক। সেই অপরাধ বোধ আজও দেবেশের মন কুড়েকুড়ে খায়।তাই অনেক কষ্টে তিলতিল করে টাকা জমিয়ে এবার সত্যি সত্যি পুরী যাচ্ছে ওরা।
দেবেশ মিঠুর কথায় মৃদু হেসে বললো, ‘সে হচ্ছে না ম্যাডাম। তোমাকে কোলে করে গেট পর্যন্ত তাই তো নিয়ে যাচ্ছি।’
-‘হুম.. নামাও না..’
-‘মা জলদি আসো। ট্রেনের টাইম হয়ে গেল।’
কু ঝিকঝিক ট্রেন ছাড়ল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সকাল সাতটা দশ মিনিটে।
মিঠুর অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হলো আজ।সবচেয়ে কম খরচে পুরী যাওয়া যায় জগন্নাথ দেব দর্শনে। তাও সম্ভব হচ্ছিলো না দেবেশের। সংসার চালাতেই হিমশিম খায় দেবেশ। পকেটে একটা টাকা থাকে না মাসের শেষে। জমানোর কথা তো দেবেশ ভাবতেই পারে না। মিঠুকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল দেবেশ। মিঠুর গিন্নিপনা দেখবে বলে।কোমরে চাবির ছরা ঝুলবে। একগাল পান থাকবে গিন্নির মুখে মানে- মিঠুর মুখে। চওড়া করে সিঁথিতে সিঁদুর পড়বে মিঠু। সব ইচ্ছে মনেই রয়ে গেল দেবেশের। আলমারিতে মিঠুর দু’ চারটে শাড়ি পড়ে আছে। আর ইমিটিশনের কিছু গয়না। তার জন্য আবার চাবির ছরা! চোরের ভারি বয়ে গেছে ঐ কটা জিনিস চুরি করতে আসার। চোরদের কি আত্মসম্মান বলতে কিচ্ছু নেই ।
‘এই শোনো না আমি কিন্তু সমুদ্রে ঝাঁপাবো জিন্স টপ পড়ে। তুমি আমার পছন্দ এতো বোঝো। তা আট বছর ধরে কেন বোঝনি। আমি কি ড্রেস পড়তে ভালবাসি।’
দেবেশ মাথা নিচু করে বললো, ‘আট বছরে প্রথম তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম।’
-‘উহু হানিমুন বলো।’ মিঠুর বাঁকা ঠোঁটের হাসি দেবেশের ব্যঙ্গ মনে হল।
কথা না বাড়িয়ে দেবেশ কুমারকে নিজের কোলে শুইয়ে ওর মাথায় চাপর দিতে লাগলো।
মিঠু সানন্দা পত্রিকাতে মুখ গুঁজে রইলো।
ট্রেন চলছে। এর মধ্যে চা খেয়ে নিল ওরা। টিফিন করে মিঠু জানলার দিকে তাকিয়ে আছে ।দেবেশের সাথে আর কোনও কথা বললো না মিঠু।
ট্রেন থামল পুরীতে দুপুরের শেষে।
কুমার বললো, ‘বাবা কুলিকে ডাকো না..’
মিঠু বললো,’না সোনা আমাদের বেশি লাগেজ নেই, চলো চলো ।
বেশ সস্তার হোটেল বুক করেছিল দেবেশ। তবে এতোটা সস্তা মিঠু ভাবতে পারেনি। হোটেলের ঘর তো না যেন গুমটি দোকান।

‘মিঠাই মা তাড়াতাড়ি নে গুমটির দোকানটা আজ রঙ করবো।’
-‘হ্যাঁ বাবা চলো।’
মিঠু ওর বাবার সাথে গুমটির দোকান চালাতো।তেল, লবণ, মশলাপাতি, লজেন্স, গুটখা, পানপরাগ। সিগারেট বিড়ি তো আছেই। কতো বদ ছেলের নজর ছিল মিঠুর দিকে। সুন্দরী মিঠুর একটু আধটু অহংকার ছিল। পাত্তা দিত না আলতু ফালতু ছেলেদের।
বড়লোক ছেলে হলেই হবে। ব্যস আর কিছু চায়না মিঠু। গরীব মানেই ফালতু ছেলে। দৃষ্টিভঙ্গি ওর এমনই ছিল ।আট বছর আগে একদিন সন্ধ্যা বেলায় টাই স্যুট পড়ে এক বনেদি পরিবারের ছেলে সিগারেট কিনতে এসে ছিল ওদের দোকানে। তখন মিঠু একাই ছিল। কথা বলার ভঙ্গি বেশ ভালো ছেলেটার।মিঠুরও কথা বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর।হয়ে গেল আর কি..মিঠুর দোকানে মাঝে মধ্যেই আসতো বনেদি পরিবারের ছেলেটি।
একদিন মিঠু নাম জিজ্ঞাসা করলো ছেলেটির
-দেবেশ রায়
-তোমার নাম কি ?
-মিঠু দে
মিঠুর বাবা একটু আঁচ করেছিল। একদিন মিঠুর বাবা দেবেশ রায়কে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কি কাজ করো করো বাবা? দেবেশ বললো, ‘ব্যান্ড বক্সে কাজ করি।’
মিঠুর বাবা বললো, ‘তা ভালো বাবা, খুব নামী কোম্পানি তাই না?’

দেবেশ বললো, ‘আমি মিঠুকে বিয়ে করতে চাই।’
ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল ওদের।
‘এই মিঠু কি ভাবছো চলো পুজো দিতে যাব তো।’
মিঠু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে।
“হ্যাঁ, চলো।”
জগন্নাথ দর্শন করে পুজো দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে আসে। রাতে বেশ খানেক ক্ষণ বিচে ছিল ওরা। কুমার বেলুন নিয়ে খেলতে থাকলো। তারপর রুটি তারকা নিয়ে হোটেলে ফিরে এল ওরা।
মিঠু রাতে শোওয়ার আগে জিন্স টপটা ব্যাগ থেকে বের করে রাখলো। কতো দিন পর পড়বে মিঠু জিন্স টপ।
মিঠুকে ওর বাবা বিয়ের দিন আশীর্বাদ করে বলেছিল, ‘যা যা স্বপ্ন মনে যত্ন করে তুলে রেখেছিলিস, সব সত্যি হবে এবার। সুখী হয় মা।’
কখন হবে ভোর! চাদর জড়িয়ে দেবেশের হাত ধরে বিচে বসবে। সূর্য ওঠা দেখবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সূর্য ওঠা নাই বা দেখা হলো। এটাই বা কম কি। আসলে মন ভোলানো কথাতে নিজের স্বপ্নের সাথে মধ্যস্থতা করছে মিঠু।
ভোর চারটে ঢেউয়ের গর্জনে গমগম করছে পুরীর সমুদ্রের বিচ। মিঠুর ভাবনা চিন্তা দেবেশের ওপর অভিমান রাগ সব ঢেউয়ের সাথে চলে গেল।দেবেশের ঘাড়ে মাথা রেখে মিঠু গুনগুন করে গান গাইছে। দেবেশকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। দেরিতে হলেও বেড়াতে নিয়ে এসেছে মিঠুকে। এটা ভেবেই দেবেশের ভালো লাগছে। তারপর ঘন্টা খানেক বিচে বসে ওরা হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিল।
সকাল এগারোটা বাজে। মিঠু জিন্স টপটা পড়ে তৈরি হয়ে নিল সমুদ্রে স্নান করতে যাবে এবার।কুমার ওর মাকে দেখে বললো, ‘লুকিং নাইস্ মা।’
দেবেশ হাঁ করে তাকিয়ে আছে মিঠুর দিকে। মিঠু বললো, ‘হ্যাংলাদের মতো কি দেখছো।’
দেবেশ বললো, ‘চলো আমরা সমুদ্রে যাই।’

সমুদ্রের জলে মিঠু পা দিয়েছে। জলের ঠাণ্ডা পরশ পেয়ে মিঠু চোখ বন্ধ করে দু’ হাত বাড়িয়ে আছে দেবেশের জন্য।

-‘দেবেশদা তোমরা কবে এলে পুরীতে? বৌদি কোথায়?’

দেবেশ বললো, ‘তোমরা কবে এলে অলি?’

-‘পরশু এসেছি।’

-‘অনির্বান কোথায়?’

-‘অফিসের কাজে ব্যস্ত উনি।’
-‘ও ও তাই বলো..’

-‘দেখো না দেবেশদা আমাকে আজ ট্রেনে তুলে দিয়ে উনি কাজের জন্য এখানে থেকে যাবে আরও চারদিন। ভালো লাগে বলো?’
-‘হুম ভেরি ব্যাড।’

মিঠু চোখ খুলে পেছন ফিরে অলিকে বললো, ‘তুমি থেকে যাও অলি, আমাদের সাথে বাড়ি ফিরো।’
অলি মিঠুকে দেখে হাঁ হয়ে গেল। ‘বৌদি তুমি কি ড্রেস পড়েছো!’
অলি মিঠুর চারপাশে ঘুরছে। দেবেশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মিঠুকে ভালো করে পর্যবক্ষেণ করার পর অলি বললো, ‘দেবেশদা আমার জিন্স টপটা বৌদি পড়েছে? তুমি যে বললে আয়রন করতে দিয়েছো এক সপ্তাহ লাগবে। এটা তোমার থেকে আশা করিনি দেবেশদা। বলতেই পারতে বৌদির এই রকম ড্রেসের দরকার। দিতাম! এটা আমার সেরা গিফট বিবাহ বার্ষিকীর। ছি ছি..’ বলে অলি চলে গেল।

‘ব্যান্ড বক্স’ পাতি ভাষায় লন্ড্রির দোকানে কাজ করে দেবেশ। অলির জিন্স টপ পড়ে মিঠুকে সেদিন স্বপ্নে দেখেছিল দেবেশ। তখনই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল ওর মনে। এখন পরিস্থিতি বেশ গম্ভীর।মিঠু ঢেউয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিঠুর গায়ে সমুদ্রের নোনা জল আছাড় দিচ্ছে। চুল উড়ে যাচ্ছে..
জিন্স টপ পড়ে বাঁশির সুরে তালে তাল মিলিয়ে দেবেশের বুকে মাথা রেখে মিঠু এক পা এক পা করে এগোচ্ছে সমুদ্রের অতলে।
‘মিঠু হচ্ছেটা কি!: বলে দেবেশ ধাক্কা দিতেই মিঠু বললো, ‘বাড়ি যাব এখনই।’
দেবেশ জানে কতটা অপমানিত হতে হয়েছে মিঠুকে।
কিন্তু কিছু করার ছিল না মিঠু একটা আবদার করেছিল সেটা যদি না রাখতে পারি..
কুমার বললো, ‘বাবা আরও অনেক ক্ষণ থাকবো।’
-‘না সোনা হোটেলে যাই এখন। বিকেলে আসব।
হোটেলে ফিরে দেবেশ মিঠুকে জড়িয়ে ধরতেই মিঠু এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘আমার ইচ্ছে হয়েছিল জিন্স টপ পড়ে সমুদ্রে স্নান করবো। প্রয়োজন তো বলি নি। এতো ছোটো করলে আমাকে!’
দেবেশ মাথা নিচু করে খাটের ওপর বসে রইলো। এ অন্যায়ের সাজা পেতেই হবে ওকে। দেবেশ আর কিছু ভাবতে পারছে না।
সন্ধ্যা বেলায় কুমারের বায়না রাখতে মিঠু বিচে নিয়ে গেল কুমারকে। দেবেশ হোটেলে রইলো।কুমার পাপড়ি চাট খাচ্ছে। মিঠু চুপ করে বসে আছে। এর মধ্যে হাত ধরাধরি করে এক প্রেমিক প্রেমিকা মিঠুর সামনে এসে বসলো।
অলির কথা বলছে ছেলেটা। মিঠু ছেলেটাকে ভালো করে দেখলো, এতো অনির্বান! চমকে উঠল মিঠু। অলি তো আজ সন্ধ্যা বেলায় হাওড়ার ট্রেনে উঠবে। আর অনির্বান অফিসের কাজের জন্য এখানে থেকে গেল। তাহলে এই মেয়েটা কে? কান পেতে শুনতে লাগলো মিঠু ওদের সব কথা।
অনির্বাণ বলছে, ‘অলিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি এবার আমি নিশ্চিন্তে তোমার সাথে প্রেম করবো যুক্তামুখী। কি বোকাটাই না বানালাম অলিকে। হা হা মাই সুইট হার্ট। লাভ ইউ টু থ্রি ফোর ফাইব
হানড্রেড।’
মিঠু স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভাবতে থাকলো দেবেশ আমাকে বোকা বানালো। আমার খুশির জন্য। আর অনির্বাণ অলিকে বোকা বানালো নিজের খুশির জন্য।
মিঠু আর এক মুহূর্ত দেরি না করে কুমারকে নিয়ে হোটেলে ফিরে গেল।
দেবেশ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। মিঠু ঘরের আলো জ্বালিয়ে বললো, ‘হানিমুন করতে এসে বাবু ঘুমাচ্ছে। ওঠো চলো, ডিনার করবো ভালো রেস্টুরেন্টে। দেবেশের লালটুকটুক চোখে চোখ রেখে মিঠু বললো,’হানিমুন যদি ভালো না হয় তবে তোমাকে একটুও ভালোবাসবো না। এই বলে দিলাম।’
দেবেশ মিঠুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘আই লাভ ইউ।’
মিঠু বললো, ‘লাভ ইউ টু থ্রি ফোর ফাইব হানড্রেড।’
দেবেশ মিঠুর হাত ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘কুমার আয় সোনা আমার হাত ধর।’ দেবেশ পরম তৃপ্তি বুকে নিয়ে ভালবাসার মশাল জ্বালিয়ে স্ত্রী সন্তানের হাত ধরে চলছে সমুদ্র সৈকতে। এ চলার সাক্ষী থাকল স্বয়ং জগন্নাথদেব। আর সমুদ্র।

Loading

Leave A Comment